বইটা পড়া শুরু করছিলাম মনে হয় তিন মাস আগে, আজকে শেষ করতে পারলাম। প্রায় সাড়ে ছয়শত পেজের বই তিন মাস না লাগলেও তিন দিনে শেষ করবার বই ও নয় নিশ্চই। আবুল মনসুর আহমদ কে নতুন করে চেনাতে হবে না আশা করছি। উনার দুইটা ছোট গল্প “হুজুর কেবলা” আর “আদু ভাই” অনেকেরই পড়া। একাধারে তিনি বাংলার কিংবদন্তি ব্যাঙ্গ সাহিত্যিক এবং রাজনীতিবিদ। আর লেখকের আশি বছরের জিন্দেগীর ৫০ বছরের রাজনীতির চিত্রপট তুলে ধরার সাথে তিনি লিখে ফেলেছেন তার দৃষ্টিতে বাংলার রাজনীতির পুরো অধ্যায়।
খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন থেকে শুরু করে ব্রিটিশ বিরোধী বহু আন্দোলন, দেশভাগ, পাকিস্তান হাসিল, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লেখক সবগুলো সময়ের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়েছেন এ বইয়ে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, মহত্মা গান্ধী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, জিন্নাহ,পণ্ডিত নেহেরু, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান,এই বাংলার আন্দোলনের সাথে উঠে এসেছে উপরোক্ত নাম গুলো সহ আরো অনেকে।
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র আর মহত্মা গান্ধী দুই জনের স্বাধীনতা লাভের চিন্তা ভিন্ন হলেও উনাদের রাজনীতির সাথে দেশপ্রেম যে কত ছিল সেটা উঠে এসেছে এ বইয়ে। নেতাজী, পণ্ডিত নেহেরুর সাথে অনেক ভাল সম্পর্ক ছিল লেখকের। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান হাসিল, লাহোর প্রস্তাবের আংশিক প্রয়োগ। শেরে বাংলার মুসলিম লীগ ত্যাগ। এবং শেষে পাকিস্তান-ভারত ভাগ বাটোয়ারা। কলকাতা তেত্রিশ কোটি টাকার বিনিময়ে নিজামূদ্দিন সরকার ছেড়ে দিয়ে শেষে আরো এ বাংলা কিভাবে কলিযুগের ফাঁকির কবলে পড়ে ছয় কোটি টাকা দেনা হয়ে যায়! সোহরাওয়ার্দী ছিলেন লেখকের রাজনৈতিক লিডার, নানান রাজনৈতিক গল্প পাওয়া যাবে এই বইয়ে সাথে দেশের জন্য ওনাদের ত্যাগ।
বৃদ্ধ শেরে বাংলার সাথে দুঃসময়ে লেখক একবার বলে ফেলেছিলেন, আপনার এতো সমালোচক কেন? কই আমাদের তো কেউ কিছু বলে না। দোষ ধরে না। তখন শেরেবাংলা বললেন, শোন মনসুর, মানুষ ফজলী আম গাছের দিকেই ঢিল মারে; শেওড়া গাছের দিকে মারে না। দু এক লাইনে অবশ্যই ব্যাপারগুলা বলা যাবে না। পড়ে দেখলে কথাগুলোর তাৎপর্য বুজতে পারবেন।
শেষে পাকিস্তানিদের কাছে এ বাংলার অত্যাচার, বঞ্চনার কাহিনী। এবং যেহেতু আবুল মনসুর আহমদ পাকিস্তান আমলে সোহরাওয়ার্দী সরকারের আমলে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী হয়েছিলেন তো পাকিস্তানীদের উপরের লোকদের এ বাংলার প্রতি কেমন মনোভাব ছিল তা দেখা যাবে। নানান ভাবে পুর্ব বাংলাকে উন্নত করার প্রয়াস ছিল বাংলার নেতাদের কিন্তু ক্ষমতা যে পাকিস্তানে!
অতঃপর ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, গন অভ্যুথান, ৭ ই মার্চ। এবং ‘দ্য হিরো অব বাংলাদেশ, শেখ মুজিবুর রহমান’ সম্পর্কে অনেক তথ্য মিলবে এই বইয়ে। ২রা মার্চ থেকে ২৫ ই মার্চ পর্যন্ত দেশে ইয়াহিয়া ক্ষমতায় থাকলেও দেশ চলেছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। এবং ছাত্রদের চাপ থাকা সত্ত্বেও নেতা শেখ মুজিব বুদ্ধিমত্তার সাথে ৭ ই মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা না দেয়া। সব কিছুর যৌক্তিক সমালোচনা আছে এ বইয়ে। শেষে বাংলার স্বাধীনতা ও ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা। এবং স্বাধীন দেশে ১০ ই জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশের মানুষ এক হয়ে দল মত নির্বিশেষে তাদের নেতা শেখ মুজিবের জন্য অপেক্ষা। দোয়া, প্রার্থনা। আপনার কল্পনা শক্তি ভাল হলে আপনি সে অপেক্ষা অনুভব করে দেখতে পারেন!
রাজনৈতিক এবং ব্যাক্তিগত দিক থেকে বঙ্গবন্ধুর সাথে লেখকের ভাল সম্পর্ক ছিল। যে কোন দরকারে শেখ মুজিব সহ অন্যান্য নেতারা পরামর্শ নিতে আসতেন অভিজ্ঞ মনসুর আহমদের কাছে। এই বইয়ে তিনি মজা করে নিজেকে রাজনৈতিক হরিঠাকুর বলে দাবি করেছেন; যে কোন নেতার বা নেতৃত্বের খটকা দেখলে দেশের ভালোর জন্য সমালোচনা করবেন। এটা অনেক দরকারি একটা জিনিস। এখন তো দুইটার ই অভাব; দেশের ভালোর জন্য সমালোচনা আর নেতাদের সমালোচনা সহ্য করার ক্ষমতা।
সদ্য স্বাধীন একটা দেশ। সব কিছুই নতুন করে গুচাতে হবে। সে পথে বঙ্গবন্ধু সরকার সংবিধান রচনার কাজে হাত দিলেন, এবং সেখানে কিছু জিনিসে সমস্যা আছে জানালেন মনসুর আহমদ। বঙ্গবন্ধু তার নিকট এক কপি সংবিধান পাঠিয়ে দিয়ে বললেন, যেগুলা ঠিক করা লাগবে বলে দিতে; সব মেনে নেয়া হবে। এই নেতাই তো আমরা চাই। কিন্তু আমরা হারিয়েছি, অনেক বড় কিছু হারিয়েছি।
এই বইটা লেখা শেষ করেছিলেন ১৯৭৩ এর শেষের দিকে, বঙ্গবন্ধুর সরকারের সাফল্য ও বাংলাদেশের সমৃদ্ধি কামনায় মোনাজাত করিয়া। লেখক যেহেতু ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন, লেখক নিশ্চই বুজতে পেরেছিলেন; মোনাজাত কবুল হয় নাই!
এই বইয়ে লেখক ঘটনা বর্ণ্নার থেকে ঘটনার মাঝের রাজনীতি টাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন; তো যারা টুকটাক বা ভালভাবে রাজনীতি করতে চায়, বা রাজনীতি যে নিজস্ব উন্নতি ছাড়াও কি বিশাল পরিমাণে দেশপ্রেম প্রকাশের মাধ্যম সেটা বুজতে চায় বা ইতিহাস জানতে চায় তাদের জন্য এ বই অবশ্যই পাঠ্য।
কিছু প্রাসঙ্গিক পৃষ্ঠা বই থেকেঃ